বাংলা ব্যাকরণের ধ্বনি পরিবর্তন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে শুরু করে চাকরির পড়ালেখা সবখানে এটির আলোচনা রয়েছে। আমরা অনেকে বাংলা ব্যাকরণের ধ্বনি পরিবর্তন বিষয়টি পড়েছি কিন্তু মনে রাখা কঠিন হয়ে যায়। তাই আজকের পোস্টে বাংলা ব্যাকরণের ধ্বনি পরিবর্তন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
বাংলা ব্যাকরণের ধ্বনি পরিবর্তন
সকল ভাষা, সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়। এই পবিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল সেই ভাষার ধ্বনির পরিবর্তন। ধ্বনি পরিবর্তন বলতে সাধারণত, শব্দের উচ্চারণে পরিবর্তন সেই সাথে শব্দের মূল রূপ পরিবর্তিত হয়ে নতুন রূপ লাভ করাকে বোঝায়।
ধ্বনি পরিবর্তনের কারণ ও ধারা
স্বাভাবিক কারণ:
- উচ্চারণ সুবিধার জন্য ।
- মুখের অঙ্গের গঠন ভিন্ন হওয়ার কারণে ধ্বনির পরিবর্তন হয়ে থাকে।
- সময়ের প্রভাবে অর্থাৎ সময়ের সাথে সাথে ধ্বনির পরিবর্তন হয়।
অস্বাভাবিক কারণ:
- ভাষার সংমিশ্রণে ধ্বনির পরিবর্তন হয়
- অলসতার কারণে সহজ উচ্চরণে ধ্বনির পরিবর্তন হয়।
- ভুল উচ্চারণে ধ্বনির পরিবর্তন হয়ে থাকে।
ধ্বনি পরিবর্তন কত প্রকার
ধ্বনির পরিবর্তন ১৬ বা তার বেশি ভাবে হয়ে থাকে নিচে বাংলা ধ্বনি পরিবর্তনের প্রধান সূত্রগুলো উদাহরণসহ ব্যাখ্যা করা হলো।
🔶🔶 স্বরাগম
উচ্চারণকে সহজতর করার জন্য শব্দে স্বরধ্বনির আগমনকে স্বরাগম বলে। যেমন: স্টেশন > ই + স্টিশন, স্ত্রী > ই + স্ত্রী, স্প্রিং > ই + স্প্রিং।
ক) আদি স্বরাগম: শব্দের আদিতে বা শুরুতে স্বরধ্বনির আগমন ঘটলে তাকে আদি স্বরাগম বলে। যেমন: স্ত্রী > ই + স্ত্রী, স্কুল > ই + স্কুল > , স্টিমার > ই + স্টিমার। এরূপ- স্টেবল-আসতাবল, স্পর্ধা-আস্পর্ধা ইত্যাদি।
খ) মধ্য স্বরাগম: উচ্চারণের সুবিধার জন্য সংযুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনির মাঝখানে বা শব্দের মাঝখানে স্বরধ্বনির আগমন ঘটলে তাকে মধ্য স্বরাগম বলে।
ধ্বনি পরিবর্তনের উদাহরণ
অ- রত্ন > রতন, ধর্ম > ধরম, স্বপ্ন > স্বপন, হর্ষ > হরষ।
ই – প্রীতি > পিরীতি, ফিল্ম > ফিলিম, ডাল > ডাইল।
উ – ভ্রু > ভুরু, চাল > চাউল, মুক্তা > মুকুতা, তুর্ক > তুরুক।
এ – গ্রাম > গেরাম, প্রেক > পেরেক, ¯্রফে > সেরেফ।
গ) অন্ত্য স্বরাগম : উচ্চারণের সময় শব্দের শেষে স্বরধ্বনি আসলে তাকে অন্ত্য স্বরাগম বলে। যেমন-
দিশ্্ + আ = দিশা, বেঞ্চ্ + ই = বেঞ্চি, পোকত্ + ও = পোক্ত।
🔶🔶 অপিনিহিতি .
কোন শব্দের মধ্যকার স্বরধ্বনি (ই বা উ) যদি যথাস্থানে উচ্চারিত না হয়ে পূর্বে উচ্চারিত হয় তবে তাকে অপিনিহিতি বলে। যেমন-
করিয়া – ক + অ + র + ই + য় + আ
কইর্যা – ক + অ + ই + র + য় + অ্যা
এটি হল অপিনিহিত শব্দ আর প্রক্রিয়া হল অপিনিহিত।
উদাহরণ:
ক) ই-কারের অপিনিহিতি : করিয়া > কর্ই্য়া; আলিপনা > আইল্পনা; রাখিয়া > রাইখ্যা; রাতি > রাইত।
খ) উ-কারের অপিনিহিতি: সাধু > সাউধ; গাছুয়া > গাউছুয়া; মাছুয়া > মাউছুয়া; হাটুয়া > হাউটুয়া; পটুয়া > পউটুয়া ইত্যাদি।
গ) য-ফলার অন্তর্গত ই-ধ্বণির অপিনিহিতি: এই অপিনিহিতির ব্যবহার সাধারণত বাংলাদেশে হয়। যেমন: কন্যা > কইন্ন্যা; সত্য > সইত্ত ; কাব্য > কাইব্্ব ইত্যাদি।
🔶🔶 অভিশ্রুতি .
অপিনিহিত শব্দের স্বরধ্বনিগুলো পরিবর্তিত হয়ে যদি শব্দটি নতুন রুপ ধারণ করে তবে তাকে অভিশ্রুতি বলে।
মূল শব্দ অপিনিহিত শব্দ অভিশ্রুতি
করিয়া > কইর্যা > করে
আজি > আইজ > আজ
আসিয়া > আইস্যা > এসে
সকল সাধু ভাষার ক্রিয়াপদ অভিশ্রুতির মাধ্যমে চলিতরূপ রাভ করে।
🔶🔶 সম্প্রকর্ষ বা স্বরলোপ.
দ্রæত উচ্চারণের জন্য শব্দের কোন স্বরধ্বনি লোপকে সম্প্রকর্ষ বা স্বরলোপ বলে। যেমন- বসতি > বস্তি, রাধ্্না > রান্না।
ক) আদি স্বরলোপ: শব্দের আদিতে স্বরধ্বনি থাকলে তা লোপ পাওয়াকে আদি স্বরলোপ বলে। যেমন- অলাবু > লাবু > লাউ,
উদ্ধার > উধার > ধার।
খ) মধ্য স্বরলোপ: শব্দের আদিতে শ্বাসাঘাত থাকলে শব্দের মধ্যবর্তী কোন স্বরধ্বনি ক্ষীণ হয়ে ক্রমশ লোপ পেয়ে যায়, একে মধ্য স্বরলোপ বলে। যেমন- অগুরু > অগ্রæ, সুবর্ণ > স্বর্ণ, গৃহিনী > গিন্নী।
গ) অন্ত্য স্বরলোপ: শব্দের শেষে শ্বাসাঘাত জোর কমে এলে স্বরধ্বনির উচ্চারণ ক্ষীণ হয়ে লোপ পায়, একে অন্ত্য স্বরলোপ বলে। যেমন- অগ্নি > আগুন, সন্ধ্য > সাঞমা > সাঁঝ।
স্বরলোপ প্রকৃতপক্ষে স্বরাগমের বিপরীত।
🔶🔶 স্বরভক্তি বা বিপ্রকর্ষ .
সংযুক্ত ব্যঞ্জন বর্ণের কঠিন উচ্চারণকে সহজতর করার জন্য একে ভেঙ্গে উচ্চারণ করাকে স্বরভক্তি বা বিপ্রকর্ষ বলে। যেমন-
অ – কর্ম > করম, ধর্ম > ধরম, রত্ন > রতন
ই – মিত্র > মিত্তির, শ্রী > ছিরি
উ – শুক্র > শুক্কুর, তর্ক > তুরুক
এ – গ্রাম > গেরাম, শ্রাদ্ধ > ছেরাদ্ধ
ও – শ্লোক > শোলক, চক্র > চক্কোর
ঋ – তৃপ্ত > তিরপিত, সৃজিল > সিরজিল
মূলত মধ্য স্বরাগম ও বিপ্রকর্ষ একই।
🔶🔶 স্বরসঙ্গতি .
এক স্বরের প্রভাবে অন্য স্বরের পরিবর্তন আলাদা স্বরঙ্গতি বলে। যেমন: দেশি > দিশি, বিলাতি > বিলিতি, বুড়া > বুড়ো।
ক) প্রগত স্বরসঙ্গতি : আদি স্বরের প্রভাবে পরবর্তী স্বর পরিবর্তিত হলে তাকে প্রগত স্বরসঙ্গতি বলে। যেমন- মুলা > মুলো, শিকা > শিকে, যতন > যতোন।
খ) পরাগত স্বরসঙ্গতি: পরবর্তী স্বরের প্রভাবে আদিস্বরের পরিবর্তন হলে তাকে পরাগত স্বরসঙ্গতি বলে। যেমন-
দেশি > দিশি, আখো > এখো, শিয়াল > শেয়াল, লিখে > লেখে।
গ) মধ্যগত স্বরসঙ্গতি: আদিস্বর অথবা অন্ত্যস্বর অনুযায়ী মধ্যস্বর পরিবর্তিত হলে মধ্যগত স্বরসঙ্গতি হয়।
যেমন- বিলাতি > বিলিতি: আদ্য এবং অন্ত্য উভয় স্বরের প্রভাবিত হয়ে পরিবর্তিত হলে তাকে অন্যোন্য বলে।
যেমন: মোজা > মুজো; পোষ্য > পুষ্যি।
২. ব্যঞ্জনধ্বনির পরিবর্তন:
🔶🔶 সমীভবন .
শব্দ মধ্যস্থিত দুটো ভিন্ন ধ্বনি একে অপরের প্রভাবে অল্পবিস্তর সমতা লাভ করে, ধ্বনি পরিবর্তনের এ নীতিকে বলা হয় সমীভবন।
যেমন- চক্র > চক্ক, পদ্ম > পদ্দ, লগ্ন > লগ্ণ, কান্না > কাঁদ্না।
ক) প্রগত সমীভবন: পূর্ব ধ্বনির প্রভাবে পরবর্তী ধ্বনির পরিবর্তন ঘটলে প্রগত সমীভবন বলে। যেমন- চক্র * চক্্ক, পদ্ম * পদ্দ।
খ) পরাগত সমীভবন: পরবর্তী ধ্বনির প্রভাবে পূর্ববর্তী ধ্বনির পরিবর্তন হল পরাগত সমীভবন বলে। যেমন-
তৎ + জন্য > তজ্জন্য, তৎ + হিত > তদ্ধিত, উৎ+মুখ > উন্মুখ।
গ) অন্যোন্য সমীভবন: যখন পরস্পরের প্রভাবে দুটো ধ্বনিই পরিবর্তিত হয় তখন তাকে অন্যোন্য সমীভবন বলে। যেমন-
মিথ্যা > মিছা, মক্ষি > মাছি; মধ্য > মাঝ ইত্যাদি।
🔶🔶 বিষমীভবন .
পদ মধ্যস্থিত দুটি সমবর্ণের একটি পরিবর্তিত হলে তাকে বিষমীভবন বলে। যখন দুটি অভিন্ন বা একজাতীয় ধ্বনির একটি বদলে যায়, তখন তাকে বিষমীভবন বলে। যেমন- শরীর > শরীল, লাল > নাল, আরমারিও > আলমারী।
🔶🔶 ধ্বনি বিপর্যয় .
শব্দের মধ্যকার দুটো ব্যঞ্জনবর্ণের পরস্পরের মধ্যে যদি স্থান পরিবর্তন ঘটে তবে তাকে বর্ণ বিপর্যয় বলে। যেমন- পিশাচ > পিচাশ, বাক্স > বাস্্ক, রিক্সা > রিস্কা, জানালা > জালানা।
সাধারণভাবে ব্যঞ্জনের ক্ষেত্রেই কেবল বর্ণ বিপর্যয় ঘটে।
🔶🔶 অসমীকরণ .
একই স্বরের পুনরাবৃত্তি দূর করার জন্য মাঝখানে স্বরধ্বনি যুক্ত হলে তাকে অসমীকরণ বলে। ধপ > ধপাধপ, টপ + টপ > টপাটপ।
আরো পড়ুনঃ
ধ্বনি পরিবর্তন pdf পেতে আমাদের কমেন্ট করুন।