You are currently viewing চর্যাপদ সম্পর্কে বিস্তারিত

চর্যাপদ সম্পর্কে বিস্তারিত

চর্যাপদ

প্রাচীন যুগের বাংলা সাহিত্যের একমাত্র নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক নিদর্শন ‘চর্যাপদ’। ১৮৮২ সালে প্রকাশিত হয় রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র রচিত ‘‘Sanskrit Buddhist Literature in Nepal’’ গ্রন্থটি। এ গ্রন্থে নেপালের বৌদ্ধতান্ত্রিক সাহিত্যের কথা প্রকাশ পায়।
ড. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯০৭ সালে নেপালে রাজ গ্রন্থাগার থেকে কতগুলো পদ আবিস্কার করেন। তার সম্পাদনায় ৪টি পুঁথি একত্রে ‘হাজার বছরের পুরান বাঙালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা’ নামে ১৯১৬ সালে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ’ কর্তৃক প্রকাশিত হয়। পুঁথি চারটি হচ্ছে- চর্যাচর্য বিনিশ্চয়, সরহপাদের দোহা, কৃষ্ণপাদের দোহা ও ডাকার্ণব। পুঁথি চারটির মধ্যে বাংলায় রচিত একমাত্র পুঁথি চর্যাচর্যবিনিশ্চয়। সরহপাদের দোহা, কৃষ্ণপাদের দোহা ও ডাকার্নব পুঁথি তিনটি অপভ্রংশ ভাষায় রচিত।
চর্যাপদ হল বৌদ্ধ সহজিয়াদের সাধন সংগীত। বৌদ্ধ সহজযানী ও বজ্রযানী আচার্যগণ সিদ্ধাচার্য নামে খ্যাত ছিলেন। চর্যার গানগুলো থেকে বাংলা ভাষার ঠিক আগেকার নমুনা এবং সেকালের সমাজের চিত্র পাওয়া যায়। এসব গানের অর্থ খুব পরিস্কার নয়। এর বাইরের অর্থ এবং অন্তর্নিহিত অর্থ রয়েছে। বাইরের কথাগুলোকে রূপক হিসেবে ধরে নিয়ে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ সাধনার গুঢ় কথা বলার চেষ্টা করেছেন। এজন্য পÐিতেরা এর ভাষাকে আলো-আঁধারী বা সান্ধ্য ভাষা বলেছেন।
পাল আমল থেকে চর্যাপদ লেখা শুরু হয়। সপ্তম শতাব্দী হতে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে চর্যাপদ রচিত হয়। চর্যাপদের ধর্মমত সম্পর্কে প্রথম আলোচনা করেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯২৭ সালে। চর্যাপদের ভাষা নিয়ে প্রথম আলোচনা করেন বিজয়চন্দ্র মজুমদার ১৯২০ সালে।। চর্যাপদ পয়ার ও ত্রিপদী ছন্দে রচিত। চর্যাপদের প্রথম ভাষাতাত্তি¡ক বৈশিষ্ট্য আলোচনা করেন ড. সুনীতকুমার চট্ট্রোপাধ্যায়-১৯২৬ সালে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ OBDL অর্থাৎ Origin & Development of Bengali Language। এ গ্রন্থে তিনি প্রমাণ করেন যে চর্যাপদের ভাষা বাংলা। ড. শহীদুল্লাহর মতে, চর্যাপদের ভাষা বঙ্গকামরুপী।
চর্যাপদের পুঁথিটির নাম ছিল- চর্যাগীতিকোষ এবং সংস্কৃত টীকার নাম চর্যাচর্য বিনিশ্চয়। চর্যাপদের সংস্কৃত টীকাকার হচ্ছেন- মুনিদত্ত। তিনি ৪০টি পদের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। চর্যাপদ মূলত গানের সংকলন।
চর্যাপদে মোট পদের সংখ্যা- ৫১টি। উদ্ধার করা মোট পদের সংখ্যা- সাড়ে ৪৬টি। পাওয়া যায়নি- ২৪, ২৫, ৪৮ নং এবং ২৩ নং এর অর্ধেক পদ। তাছাড়া ১১ নং পদকে প্রাপ্তি তালিকায় গণ্য করা হয়নি (টীকাভাষ্য নেই)। ড. প্রবোধ চন্দ্র বাগচী চর্যাপদের তিব্বতি অনুবাদ আবিষ্কার করেন এবং ১৯৩৮ সালে প্রকাশ করেন।
চর্যাপদের তিব্বতী অনুবাদক কীর্তিচন্দ্র। চর্যাচর্যবিনিশ্চয় (চর্যাপদ) এর মোট পদকর্তা ২৪ জন। পদকর্তাদের (কবিদের) নামের শেষে গৌরব সূচক পা যোগ হয়েছে। চব্বিশ জন পদকর্তা হলেন- লুই, কুক্কুরী, বিরুআ, গুন্ডরী, চাটিল, ভুসুকু, কাহ্ন, কামলি, ডোম্বী, শান্তি, মহিত্তা, বীণা, সরহ, শবর, আর্যদের, ঢেÐণ, দারিক, ভাদে, তাড়ক, কঙ্কণ, জয়নন্দি, ধাম, তন্ত্রী ও লাড়ীডোম্বী।
🟧  লাড়ীডোম্বীপার কোনো পদ আবিষ্কৃৃত হয়নি।
চর্যার ১-সংখ্যক পদ (কাআ তরুবর পাঞ্চবি ডাল) লুইপা’র রচনা। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লুইপাকে (৭৩০-৮২০ খ্রিষ্টাব্দ) আদি কবি মনে করেন। লুইপা প্রথম বাঙালি কবি। তার কবিতায় ‘পউআ’ খালের (পদ্মা) উল্লেখ রয়েছে। তবে শহীদুল্লাহ দেখিয়েছেন, প্রাচীনতম চর্যাকার হলেন শবরপা।
🟧 চর্যাপদের কবিদের মধ্যে লুই, কুক্করী, বিরুআ, ডোম্বী, শবর, ধাম ও জয়নন্দি বাঙ্গালি ছিলেন।
🟧 চর্যাপদের প্রধান কবি কাহ্নপা- কাহুপা, কৃষ্ণপাদ নামে পরিচিত। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, কাহ্নপাদের আবির্ভাব খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকে। সঙ্কলনটিতে তার ১৩টি পদ গৃহীত হয়েছে।
🟧 ভুসুকুপা কবির ছদ্মনাম। তার আসল নাম শান্তিদেব। ভুসুকুপা সৌরাষ্ট্রের রাজপুত্র ছিলেন। তার সময় একাদশ শতক। ভুসুকুপা সংখ্যার বিচারে চর্যার দ্বিতীয় প্রধান কবি। তার পদের সংখ্যা ৮।
ভসুকুপার একটি পদের দুটি পঙ্ক্তি হচ্ছে-
“আজি ভুসুক বাঙ্গালী ভইলী।
নিয়া ঘরিণী চন্ডালে লেলী”
অর্থাৎ আজিকে ভুসুকু হলি বঙ্গাল/আপন গৃহিনী তোর লইল চন্ডাল। পঙ্ক্তি দুটি দেখে মনে হয় তিনি-বাঙালি ছিলেন। তবে সে সময় বঙ্গের অধিবাসী বোঝাতে বাঙ্গালী বা বাঙ্গালি শব্দের ব্যবহার শুরু হয়নি। ভুসুকুপা জাত হারানো, অধঃপতিত বা ব্রাত্য হওয়ার ধারণায় বাঙালী শব্দ ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ চন্ডাল স্ত্রী গ্রহণ করার তিনি বাঙ্গালী হলেন।
🟧 চর্যাপদের প্রথম (১নং) পদটি রচনা করেছেন লুই পা।
🟧 চর্যাপদের প্রথম পদের দু’ পঙ্ক্তি হল-
কাআ তরুবর পঞ্চবি ডাল।
চঞ্চল চিএ পইঠা কাল।।
চর্যাপদ নেপালে পাওয়া গিয়েছিল কারণ, তুর্কী (মতান্তরে সেন রাজাদের) আক্রমণকারীদের ভয়ে বৌদ্ধ সাধকগণ তাদের পুঁথি নিয়ে নেপালে পালিয়ে গিয়েছিলেন।
চর্যাপদে ছয়টি প্রবাদ বাক্য পাওয়া যায়। প্রবাদ বাক্যগুলোর মধ্যে দুটি হল-
১। অপণা মাংসে হরিণা বৈরী।
২। দুহিল দুধু কি বেণ্টে সামায়।
🟧 ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, চর্যাপদের রচনাকাল ৬৫০ থেকে ১২০০ খ্রিষ্টাব্দ। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, চর্যাপদের রচনাকাল ৯৫০ থেকে ১২০০ খ্রিষ্টাব্দ।
🟧 ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, প্রথম বাঙ্গালি কবি মৎস্যেন্দ্রনাথ বা মীন নাথ। তিনি সপ্তম শতকে জীবিত ছিলেন। চর্যাপদে মীননাথের কোনো পদ নেই। ২১ সংখ্যক পদের টীকায় চারটি পঙ্ক্তি আছে।
🟧 ফরাসি পÐিত সিলভ্যাঁ লেভীর মতে মৎস্যেন্দনাথ ৬৫৭ খ্রিষ্টাব্দে রাজা নরেন্দ্রদেবের রাজত্বকালে নেপালে গিয়েছিলেন।
🟧 রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে লুইপা রাজা ধর্মপালের সময়ে (অর্থাৎ ৭৬৯-৮০৯ খ্রি.) বর্তমান ছিলেন।

Leave a Reply